নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন সুভাষচন্দ্র থেকে নেতাজি হয়ে উঠেছিলেন তখন শুধু দেশ নয়, সারা বিশ্বই বিস্মিত হয়েছিল। তিনি যে গোড়া থেকেই নিজেকে সেইমতো তৈরি করেছিলেন তা আর এখন অজানা নয়। কিন্তু নিজেকে তৈরি করার সেই পর্বে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দির ছিল নেতাজির আশ্রয় ও শক্তির উৎসস্থান। তার এলগিন রোডের বাড়িতে শয়ন কক্ষের একদম ঘরের কোণে মা কালীর মূর্তির ছবি বাঁধানো আছে। বলাবাহুল্য, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সাথে তার অন্তরের যোগ ছিল। মা কালীর টানেই তিনি প্রায় দিন ছুটে যেতেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। শ্যামাসঙ্গীত খুব প্রিয় ছিল নেতাজির। দক্ষিণেশ্বর থেকে বেলুড়মঠ যাবার পথে গঙ্গা পেরিয়ে যাওয়ার সময় নৌকায় বসে গুনগুন করে শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। আর সেই নৌকায় তার সাথে থাকতেন প্রফুল্ল সরকারের মতো বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষেরা।
পরাধীন ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারাটির দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেদিনের ভারতকে পথ দেখাতে অখন্ডের ঘর থেকে যে ঋষি নেমে এসেছিলেন তিনিই স্বামী বিবেকানন্দ। স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উপলব্ধি ছিল- দেবতাদেরও অগম যে সাধনার স্তর, সেখানেই বিবেকানন্দের অধিষ্ঠান। তাঁর গুরুর মন্ত্র ছিল, জীব ও শীবে প্রভেদ না করার। সেই মন্ত্রটিকে চালিত করে বিবেকানন্দ শুধু দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে দেশের উন্নতির চেষ্টায় করেননি, বরং ধর্মাচরণের সংজ্ঞাটিকেই বদলে দিয়েছিলেন।
বিবেকানন্দ ও নেতাজি দুজনেই সন্ন্যাসী ও সৈনিক কিন্তু ভিন্ন অর্থে ও প্রেক্ষিতে তারা ভাস্বর। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় তাঁর 'ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব' এই গ্রন্থে লিখেছিলেন - "আদর্শের বিনিময়ে আপোস করার প্রবৃওি তাঁর চিওকে কোনকালে বিড়ম্বিত করতে পারল না। কারন, তাকে নিয়ত প্রাণশক্তি দান করতে থাকলেন দূর গগনে দীপ্যমান সূর্যের মতো মহাবীর্যবান অপর এক আপসহীন সংগ্রামী - স্বামী বিবেকানন্দ। দেশবাসী আজও বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় বিশ্বাস করে যে, বিবেকানন্দের সর্বসওাই বুঝি সুভাষচন্দ্রের মধ্যে পুর্নজন্ম গ্রহণ করে ভারবর্ষকে ধন্য করেছে।"
নেতাজি যেখানেই যেতেন তাঁর সাথে থাকত জপের মালা, গীতা ও মায়ের পায়ের শুকনো জবা ফুল। এরদ্বারাই বোঝা যায়, শক্তি সঞ্চয় করতে মা কালীই ছিল নেতাজির ভরসা। ১৯৪১ সালে জানুয়ারি মাসে নেতাজি যখন তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্ধি, আর সেই বাড়ির উপর নজর রাখছেন প্রায় ১৫ জন ব্রিটিশ ও প্রায় ৭ টি স্তরের পুলিশ বেষ্টনী। যখন চরতরে তিনি এই দেশ ছাড়বেন সেই মহানিষ্ক্রমণের কয়েকদিন আগের রাতেই তার দুই খুড়তুতো ভাইজি ইলা ও বেলাকে গভীর রাতে দক্ষিণেশ্বরের মায়ের পায়ের ফুল ও চরণামৃত আনতে পাঠিয়েছিলেন মন্দিরে। তিনি সংকল্প নিয়েছিলেন মা ভবতারিণীর আশীর্বাদ না নিয়ে তিনি দেশত্যাগ করবেন না। ঠিক এই ঘটনার এক-দুদিন পরেই মহানিষ্ক্রমণ ঘটেছিল।
দক্ষিণেশ্বর সর্বধর্ম সমন্বয়ের একটা পীঠস্থান। নেতাজি শক্তির উপাসনা করতেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সাথেই। তিনি কারাগারে বন্ধি থাকা অবস্থাতেও মা কালীর উপাসনা করতেন। চিঠি লেখার সময় সবার উপরে লিখতেন "কালী মাতা"। সারা দেশবাসীকে বিস্মিত করে রেখে যাওয়ার আগে দক্ষিণেশ্বরের মায়ের পায়ের ফুল নিয়ে তবেই গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই যাওয়া তো চলে যাওয়া নয়, আসলে থেকে যাওয়া। যেভাবে সাধনার ইতিহাসে থেকে যান সমস্ত সন্ন্যাসীগণ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র যেমন একাধারে সন্ন্যাসী ও সৈনিক।