আমি একজন রিপোর্টার। অতএব, আমি আলোর শহর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে রিপোর্ট লিখবো, সেটাই স্বাভাবিক।
তবে না, আজ কিছু ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছে আমার। সহজ কথায়; বাংলা ভাষায়।
সঙ্গে অবশ্যই থাকছে ক্যামেরা বন্দি করা, আরও কিছু ছবির মালা, যা নিশ্চিত ভাবেই আপনাদের আলোর শহরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে। মা জগদ্ধাত্রীর দর্শন ও আশীর্বাদ আপনারাও পেতে পারেন। উৎসব, আরও একবার, আপনাদের মনে লাগতে পারে।
কবিগুরুর লেখা একটা কবিতা দিয়ে, আমার এই লেখা শুরু করেছি। এই কবিতাটি "সহজ পাঠ" এর অন্তর্গত। এই কবিতার নাম "পুজোর সানাই"। এতে শরৎ আছে, হেমন্ত আছে, শীত আছে। এই কবিতা শহুরে নয় ঠিক। বড়ো মেঠো। এই কবিতায় নিয়ম ভাঙার আনন্দ আছে। ঘরে ফেরার সুখ আছে। বড়োদের আদর আছে। ছোটদের ভালবাসা আছে।
কেবল- নেই কোনও রিপোর্ট।
আজ শেষ বিকেলে আমি গিয়ে পড়েছিলাম চন্দননগরে। এই শহরটা আমার অনেকদিনের চেনা। এই শহরের জগদ্ধাত্রী পুজোটাও। সেই এক জনজোয়ার; সেই উন্মাদনা; থিমের প্যান্ডেল; সাবেক প্রতিমা আর আলোর রোশনাই।
সব মিলিয়ে এক ধরনের "ভাইব" যা গঙ্গার পশ্চিম কূলে, একদা "ফরাসডাঙা" নামে পরিচিত এই বিখ্যাত শহরটার প্রাণ।
তবে, এই প্রাণ- শহুরে হয়েও যেন বড্ডো গেঁয়ো। বাঁধানো রাস্তাঘাট, দোকানপাট, একগাদা খাবার ও আইসক্রিমের স্টল, বিশাল বড়ো বড়ো অ্যাডের হোর্ডিং থাকা সত্ত্বেও যেন সেই তেপান্তরের মাঠ- যেখানে কাশফুল গুলো আজ মুমূর্ষু। সে মাঠে বিকেলের দিকে একটা হাল্কা কুয়াশার আস্তরণ জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর আঁধার নামে- ঝুপ করে।
সেই মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হুগলী নদী। যার অপর নাম ভাগীরথী আর বাঙালির আবেগ ও আদরে দেওয়া নাম- গঙ্গা।
সেই গঙ্গার ধারেই, সবার নজর বাঁচিয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে সেই কবেকার একটা ফ্রক পরে, পায়ে আলতা লাগিয়ে, আনমনে বসে মালা গাঁথছে।
না, ফুলের মালা নয়- ঋতুর!
সেই মেয়েটা আসলে শরৎ, হেমন্ত ও শীতকে এক মালায় গাঁথছে।
আর আপাদমস্তক শহুরে যারা?
তারা- সবাই ওই পুঁচকে মেয়েটারই এক অন্য রূপ দেখছে প্যান্ডলে প্যান্ডেলে- আলোর রোশনায়ে ঝলসে, ভিড়ের ঠেলা খেয়ে খেয়ে।
চতুর্ভূজা, সিংহবাহিনী- মা হৈমন্তীকা।
আজ আমি ফিরেছিলাম, আমারই চেনা জায়গায়। চেনা পুজোর ভিড়ে। তবুও, সেই পুঁচকে মেয়েটার অস্তিত্ব আমি টের পেয়েছি।
তাই, আমার জগদ্ধাত্রী পুজো সম্পর্কে রিপোর্ট লেখার কথা থাকলেও আমি কথায় কথায় ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। একই মালায় গেঁথে ফেলার চেষ্টা করছি ঋতুর পর ঋতু।
আমার ছবিতে আঁকিবুকি হয়ে উঠছে আমার সেই বন্ধুবর যে এ বছর প্রথমবার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোটা চাক্ষুষ করলো। আমার মালায় ঋতু হয়ে উঠছে আমার আরও এক বন্ধু ও তার বাবা।
যারা দু'জন একই গিটারটি বাজাচ্ছে। যাদের দু'জনের গাওয়া গানও একই। কেবল, একটা প্রজন্মের ফারাক দু'জনের মধ্যে। এই দুইটি মানুষের বয়সের ফারাক- ওই তিরিশ-বত্রিশ বছর।
দেখুন না! এই ছবিতেই আলো আছে। এই মালাতেই জ্যোতি।
এই তো খুঁজতে যাবেন আপনারা চন্দননগরে!
আর, গিয়ে কি দেখবেন বলুন তো?
এল.ই.ডি আলোর সারি! সূক্ষ্ম তারের পাঁজায় সাজানো জটিল সব সার্কিট! বিশাল বিশাল গেট!
বিজ্ঞানের ছবি ও ক্রিয়েটিভিটির মালা!
কি? সব ঘেঁটে যাচ্ছে?
বলি, তা একটু যাক না হয়!
সবই যে নিয়মে হতে হবে, তা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে?
সব আলোর পিছনেই একটা আঁধার থাকে- জানেন?
নির্মম, বেদনাঘন একটা পৈশাচিক অন্ধকার!
এইখানে, কথা আসে আমার তৃতীয় বন্ধুর। যার জীবনটা কিছুটা খাপছাড়া। সংগ্রামেরও বটে। সে আপাতত লড়ছে। সে লড়ে চলেছে তার চারপাশের সাথে। তার নিজেরই অস্তিত্বের সাথে। জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করার তাগিদে।
অথচ, সে কি বাচালতা! সে কি ফচকেমি তার! সময়ের মার খেয়ে খেয়ে তার "সেন্স অফ হিউমার" তুঙ্গে উঠে গেছে।
আসলে, এ কথা ধ্রুব সত্য যে, সব আঁধারের শেষেই থাকে এক চিলতে আলো।
আমার এই তৃতীয় বন্ধু, সত্যিই এক আলোর পথযাত্রী। ও কোনও "রাত্রি"-তেই থেমে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞায় বদ্ধপরিকর।
আসলে, আলোর শহরের ছেলে তো! অন্ধকার ওর সহ্য হবে কি করে!
তাহলে আমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মাতৃরূপের ছবি আঁকলাম। তাঁকে কেন্দ্র করে পাওয়া কিছু আনন্দের মালা গাঁথলাম এবং আলো ও আঁধারের ভারসাম্যের কথাও কিছুটা তুলে ধরলাম।
এবার আপনাদের কি কাজ?
একটি বার সময় করে- ৯, ১০ বা ১১-ই নভেম্বর চন্দননগরে গিয়ে পড়া।
নিজেদের গল্প-মালা-ছবি গুলো আপন হাতে তৈরি করা।
আর যদি কোথাও কোনও বেগড়বাঁই হয়...
বদলে দেবেন! চেঞ্জ করে দেবেন!
আরে মশাই! নিজেদেরই তো মাইন্ড...
চেঞ্জ করতে দোষটা কোথায়?
...
আমি যাই উঠি! ওই পুঁচকে মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে ফিরি। বাচ্চা তো! একা যে ও পথ হারাবে! খুব চঞ্চল!
- শুচিষ্মান চক্রবর্তী
ছবি সংগ্রহ ও সহায়তায়- রোহিত মুখার্জি