রুপম মিস্ত্রি : বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ একথা যথার্থ সত্য ।এই তেরো পার্বণ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে তাকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতরো করে তুলেছে। প্রতিবছর দুর্গাপুজো,কালীপুজো এবং জগদ্ধাত্রীর আরাধনার পরেই বাঙালি মেতে ওঠে রাস উৎসবে। রাসের কথা শুনলেই মাথায় আসে কৃষ্ণধাম নবদ্বীপের কথা। তবে নবদ্বীপের পাশাপাশি তালে তাল মিলিয়ে রাস পালন হয় আমাদের রাজ্যের অন্য আরেকটি জেলা শান্তিপুরে । শান্তিপুরে রাসের সূচনা করেন অদ্বৈতাচার্য। বৈষ্ণব তত্ত্ব অনুসারে জানা যায় ,অদ্বৈতাচার্য ছিলেন সদাশিবের অংশ জাত। বৈষ্ণবদের হাত ধরেই রাস পূর্ণিমা উদযাপন শুরু হলেও বর্তমানে তা সার্বজনীন। বিশেষ করে শান্তিপুরের রাসের অন্যতম বিশেষত্ব হলো - এখানকার রাস পূর্ণিমার উৎসবে ইতিহাস আর পুরান মিলেমিশে একেবারে এক হয়ে যায়।
পুরাণ বলছে, রাস সম্পর্কে অবগত না হওয়াতে সে নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিলো মহাদেব শিবের মনে। দেবী মহামায়াও নাকি কৃষ্ণের প্রতি মোহিত হয়ে রাশে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে রাসের নিয়ম অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতীত অন্য কোন পুরুষের উপস্থিতি ছিল নিয়মের বাইরে তাই শিবের উপস্থিতি অনুভব করে শ্রীকৃষ্ণ সেই মুহূর্তে রাসলীলা ত্যাগ করে চলে যায় তবে পরমুহূর্তেই সখিরা পড়েন চিন্তায় তবে কি রাস হবে না তখন তারা ঠিক করেন রাধাই হবেন রাজা তাকে দোলায় চরিয়ে নগর পরিভ্রমণে বেরোন হবে ফলে রাসলীলা বাধা পড়লে শিবির আর রাস দেখা হয় না তখন মহাদেব প্রতিজ্ঞা করেন যে এই রাস লিলা একদিন তিনি মর্তবাসীর সামনে আনবেন। যেহেতু তিনি দ্বাপর যুগে রাস ভেঙেছিলেন ,তাই অদ্বৈতাচার্য রূপে মর্তে জন্মগ্রহণ করেন এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন।
অন্যদিকে ইতিহাস বলছে, বারো ভুঁইঞার এক ভুঁইঞা ছিলেন প্রতাপাদিত্য। তিনি পুরীর রাজা ইন্দ্রদুম্নের পূজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহ যশোরে নিয়ে আসেন। এবং তার নিত্য সেবা করেন l তবে পরবর্তীকালে মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে তিনি সেই বিগ্রহ তুলে দেন তাদের গুরু অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে তার হাত ধরেই এই বিগ্রহ রাধারমন জিউ রূপে শান্তিপুরে প্রতিষ্ঠিত হন। মৃত্যুর পরে হঠাৎ একদিন তাদের বাড়িতে চুরি হয় এবং তাতে লুণ্ঠিত হয় রাধারমন জিউ মূর্তিও। স্থানীয় এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশে রাধারমন বিগ্রহের খোঁজ পান এক বিলের মধ্যে এই ঘটনার পরে গোস্বামীরা মনে করেন ব্রজমোহন বুঝি রাই বিনা কষ্ট পাচ্ছেন তাই রাস পূর্ণিমার দিনেই প্রতিষ্ঠা করা হয় রাধা মূর্তি। রাসের দিনেই মিলিত হন রাধাব্রজোমোহন।গোস্বামীদের শিষ্য খাঁ চৌধুরীদের প্রস্তাবে রাধাগোবিন্দ জিউ আর রাধার এই মিলন শোভাযাত্রার মাধ্যমে দেখানো হয় সর্বসাধারণকে। এই অনুষ্ঠানকেই বলা হয় ভাঙ্গা রাস।
বর্তমানে যাদের রাই রাজা সাজানো হয় তাদের বয়স হতে হয় ১২ অনূর্ধ্ব। এবং তাদের ব্রাহ্মণ বাড়ির কন্যা হতে হয় । রাসের আগের দিন রাতে নিরামিষ ভক্ষণ করে পরের দিন তাকে রাই সাজিয়ে বিগ্রহের সামনে বসিয়ে উৎসব শুরু হয় রাসের।
এই রাস উৎসব রাধাকৃষ্ণের মিলন উৎসব হলেও, এই উৎসব সমাজের সমস্ত শ্রেণীর ,সমস্ত বর্ণের, মানুষকে এক করে দেয়। ভেদাভেদ ভুলে সমস্ত মানুষ এক হয় এই আনন্দ উৎসবে। আজও পর্যন্ত এই রাই রাজাদের আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ তাদের দেখতে, এবং রাসলীলায় অংশগ্রহণ করতে।