দুর্গা পূজার সময় বিভ্রাট । কিভাবে হবে এইবছরের পুজো ?
হ্যালি গোস্বামী : এই বছর সূর্য সিদ্ধান্ত মতে দুর্গা পূজার তিথি এতটাই সংক্ষিপ্ত পড়েছে যে সুষ্ঠ ভাবে পূজা করে ওঠা দুষ্কর ! যেমন ধরুন অষ্টমীর দিন সকাল সাড়ে ছয়টা নাগাদ সন্ধি পূজা ! অর্থাৎ তারও আগে অষ্টমীর পূজা সম্পূর্ন করতে হবে । এই নিয়ে পুরুতদের এবং যাদের বাড়িতে পূজা হয় তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে - কিভাবে পূজা উৎরাবে ?
![]() |
ফাইল চিত্র |
তাই এই বিষয়ে ক্রিয়াকান্ড জানা ব্যক্তিদের বেশি করে লেখালেখি এবং শেয়ার করা উচিত যাতে সবার কাছে এই জ্ঞানটি ছড়িয়ে যায় । আমার আগেও কেউ কেউ এই বিষয়ে লিখেছেন । আমিও আমার মতামত যুক্ত করলাম ।
![]() |
ফাইল চিত্র |
সূর্য সিদ্ধান্তে এইরকম সল্প তিথি পড়লেও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তে কিন্তু এই বছর যথেষ্ট তিথী আছে ।
![]() |
ফাইল চিত্র |
এক বর্ষীয়ান শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত দেখলাম এই বিষয়ে বলছেন যে এই বছর প্রয়োজনে পঞ্জিকা বদল করা যেতেই পারে। যারা বলেন যে " কুল পরম্পরা ভাবে চলে আসা রীতি নীতি পদ্ধতি বা মত বদল করা অনুচিত" তাদের জানা উচিত যে পঞ্জিকা কোনও পদ্ধতি নয় । পদ্ধতি হলো কোন পুরাণ মতে পূজা নির্বাহ হচ্ছে সেটা । যেমন বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ মতে কিংবা কালীকা পুরাণ মতে ইত্যাদি । এই পর্যন্ত আমি সেই বর্ষীয়ান পণ্ডিতের সাথে সহমত ।
ছাপা পঞ্জিকা প্রচলনের পূর্বে গণক ঠাকুর ও জ্যোতির্বিদরা নিজ নিজ বংশপরম্পরা় ক্রমে প্রাপ্ত পদ্ধতিতে গণনা করতেন । এক গণক ঠাকুর মারা গেলে বা বংশ লোপ পেলে কি নুতন গণক আসবেন না ?! আধুনিক পঞ্জিকাকেও সেইরকম দুইজন গণক ধরা যেতেই পারে । অধিকাংশ বনেদি বাড়িতে যে পঞ্জিকা পরিবর্তনের ব্যাপারে ছুতমার্গ আছে সেটা অর্থহীন , কতকটা ইশ্বর ভীতি প্রসূত এবং বহুলাংশে যথার্থ শাস্ত্র জ্ঞান রোহিত পুরোহিতদের দ্বারা ভুল পথে চালিত বলে আমি মনে করি । মোট কথা পঞ্জিকা পরিবর্তন করা যেতেই পারে। ঘড়ি অচল হলে আমরা যেমন নুতন ঘড়ি আনি। আমরা কি বলব যে আমাকে ওই একশো বছর বয়েসি দম দেওয়া ঘড়িতেই সময় দেখতে হবে ?!
এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা সভয়ে বলি , জানি অনেকেই তেড়ে আসবেন । ক্যালেন্ডার গণনায় সব দেশেই অস্ট্রোনোমারদের কিছু ত্রুটি হয়ে থাকে অবধারিত ভাবে । যেমন ধরুন প্রত্যেক বছর এক চতুর্থাংশ দিন উদ্বৃত্ত হয় এবং চার বছর অন্তর সেই গাণিতিক ত্রুটিকে নির্মূল করতে একটা গোটা দিন যুক্ত করে লিপ ইয়ার ওরফে অধিবর্ষ সৃষ্টি করা হয় থাকে। লিপ ইয়ার না থাকলে তিল তিল করে ত্রুটি জমতে জমতে একশো দুশো বছরে আস্ত ক্যালেন্ডারটাই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যেতো । বিশ্বের সব দেশে এই জাতীয় গণনা বিভ্রাট হয়েছে। এবং নুতন সম্রাট এসে সেই বিভ্রাটকে দূরীভূত করতে নুতন করে ক্যালেন্ডার গণনা প্রচলন করেছেন। বিশেষত আকাশে নক্ষত্রের স্থান ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে । ঋক বেদের কালে আকাশের যেই যেই স্থানে যে যে নক্ষত্র দেখা যেতো বর্তমান কালে সেই স্থানে আর দেখা যায় না ! এবার কেউ যদি সেই বৈদিক যুগের ক্যালেন্ডার আজও অনুসরণ করে চলে ( ধরে নিন তর্কের খাতিরে ) তাহলে কিন্তু তার গণনা সম্পূর্ন ভুল চলবে !!
এইভাবেই প্রাচীন পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতিতে কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি প্রবেশ করেছিল। তখন আজকের মতন সূর্য সিদ্ধান্ত আর দৃক সিদ্ধান্ত ( বিশুদ্ধ ) এই দুই মত ছিল না । সবই প্রাচীন ঢংয়ে গণনা হতো । কিন্তু ওই ত্রুটি মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয স্বাধীনতার আগে পঞ্জিকা সংস্কার করার একটা সাধু উদ্যোগ নেওয়া হয় । জহর লাল নেহেরুর উদ্যোগে, এই গননা সঠিক ও ব্যবস্থিত ভাবে করতে ডাঃ মেঘনাদ সাহা ও ডাঃ এন সি লাহিড়ীর বিশেষ অবদান আছে । এবং আকাশের তারকা নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান জানার জন্য আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া হয় । এই ভাবে জন্ম নেই দৃকসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ওরফে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত । ভারত সরকার এই দৃক সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাকেই সরকারী ভাবে, তিথি, উৎসব, ছুটি ইত্যাদি নির্ধারণ করার জন্য অনুমোদন দিয়েছে ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে পুরাতনী পঞ্জিকার গণনায় অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে । ফলে তলিয়ে দেখতে গেলে সঠিক তিথিতে সঠিক পূজা হচ্ছে না ! হয়তো সন্ধিক্ষণ নয় , অথচ আমি সন্ধি পূজা করছি -- এইরকম চলে আসছে ! আমাদের ইশ্বর ভীতি , গোঁড়ামি , অন্ধত্ব আর ব্রাহ্মণদের অশিক্ষার প্রভাব ভুল গণনাকে বর্জন করতেও দিচ্ছে না ! সুতরাং কেউ যদি পঞ্জিকা পরিবর্তন করতে চান তিনি তা করতেই পারেন । সত্যি কথা বলতে কি , বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তের সঠিক গণনা সবারই আপন করে নেওয়া উচিত !
কিন্তু সেই পূর্বোক্ত বর্ষীয়ান পণ্ডিত এও বললেন যে আগামী কোনও বছর আবার যদি নুতন পঞ্জিকায় তিথি বিভ্রাট হয় তাহলে অনায়াসে আগের পুরোনো পঞ্জিকায় ফেরত যাওয়া যেতে পারে ! এইখানে আমি উনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। শুধুই সুবিধের জন্য পঞ্জিকা বদলে বেড়ানো সুযোগসন্ধানী মনোবৃত্তির পরিচায়ক । আমার মতে ওটা অনুচিত। তবে যুক্তিবোধ দিয়ে যদি আমি বুঝে থাকি যে প্রাচীন পঞ্জিকা ত্রুটি পূর্ণ এবং তারপর যদি আমি পরিবর্তন করতে চাই , তাহলে করতেই পারি।
২০২০ সালে মহামারীর বছর কিন্তু বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তেও ঠিক এইরকমই অল্প তিথি পড়েছিল । সে বছর মহামারীর বছর হওয়ায় পুজোর জোগাড় করার লোক ইত্যাদির প্রচণ্ড অভাব ছিল । ফলে আমাদের , মানে যারা বিশুদ্ধ মতে পূজা করি , তাদের সাপে বরই হয়েছিল । সে বছর আমার বন্ধুবর , বেলুড় মঠে দুর্গা পূজা করা ব্রহ্মচারী মহারাজ ( অধুনা সন্ন্যাস প্রাপ্ত ) আমাকে অনেক বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন , কি প্রকারে শাস্ত্র অক্ষুণ্ন রেখে পূজা করা যায় ।
খেয়াল রাখতে হবে , কোনও ক্ষেত্রেই পূজা সূর্যোদয়ের আগে শুরু করা যাবে না ! এই নিয়ম কঠোর ভাবে মানতেই হবে ! কারণ সূর্য না উঠলে নতুন দিন আরম্ভ হয় না ! অর্থাৎ আপনি আগে থেকে পূজা শুরু করলে সেগুলো সবই নিস্ফল হবে ! প্রশ্ন হচ্ছে আধ এক ঘণ্টার মধ্যে অষ্টমীর মহাপুজা কিভাবে সম্ভব । শাস্ত্র বারংবার বিধান দিচ্ছে তিথির অল্পতা হলে পূজা সংক্ষেপ হবে । কেবল পঞ্চপচার , কিংবা গন্ধ পুষ্প , কিংবা একটু জল .... চাই কি কেবল ভক্তি দ্বারা মনে মনে পূজাও এ ক্ষেত্রে সমান ভাবে সিদ্ধ হবে -- এরকম বলা আছে !
আচমন এবং সাধারণ শুদ্ধি করণ করে গুরু পঞ্চদেবতা ইত্যাদিদের উদ্দেশ্যে গন্ধপুষ্প দিয়ে সামান্য করাঙ্গন্যাস করে দেবীর ধ্যান করে সংক্ষেপে বিশেষার্ঘ্য স্থাপন করে একত্রে সব ষোড়শোপচার নিবেদন করে পূজা করা বিধেয়। আবরণ দেবতা ইত্যাদি সবার গন্ধপুষ্পে পূজা । মহাস্নান হবে সংক্ষেপে । এক ভৃঙ্গারে সমস্ত উপকরণ একটু একটু করে নিয়ে , " আত্রেয়ী ভারতী.... " মন্ত্রে দেবীর স্নান শেষ করতে হবে । আরতিও সংক্ষেপে করণীয় । প্রয়োজনে অন্য উপাচার বাদ দিয়ে কেবল দীপ দিয়েও আরতি সিদ্ধ হয় ।
এটা গেলো সাধারণ পূজার ক্রম । অষ্টমীর বিশেষ পূজা অর্থাৎ নবদুর্গা , অষ্টশক্তি , দশ দিকপাল প্রভৃতিদের সব গন্ধপুষ্পে একত্রে পূজা । এবং একত্রে পঞ্চপচার নৈবেদ্যাদি নিবেদন হবে ।
পুজোর জোগাড় একটু আগে থেকে রাত থাকতে করে রেখে সব কাজ সেরে আসনে বসবেন এবং সূর্যদয় হওয়া মাত্র সন্ধ্যা কৃত্য করে পূজা শুরু করবেন । কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে কুলপ্রথায় নিত্য ছাগ উৎসর্গ থাকলে কি ভাবে তা সম্পন্ন হবে ? এক্ষেত্রে গন্ধপুষ্পে " স্তম্ভায় নমঃ , খড়গায় নমঃ , ইত্যাদি ক্রমে সামান্য অর্চন করে সম্পূর্ন সংকল্প বাক্য পাঠ করে ছেদন হবে । সংকল্প কিন্তু করতেই হবে । চাইলে পূজার তন্ত্রধারক পুরোহিতের সুবিধার্থে আগে থাকতে ছাগ উৎসর্গের কাজগুলি এগিয়ে রাখতে পারেন ।
খুব গোঁড়া মত অনুসারে আগের দিন চন্দন বেটে রাখা কিংবা নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখা কোনোটাই চলবে না ! কারণ রাত পোহালেই সেগুলো বাসী হয়ে গেলো ! তবে আমার পরিচিত এক ব্রাহ্মণ সাধক বংশের প্রাচীন পূজায় এইরকম তিথির অল্পতা ঘটলে ওনারা ভোগ রান্নার ব্যাপারে এক অভিনব উপায় অবলম্বন করেন। রান্না রাত থাকতে আরম্ভ করলেও সূর্যোদয় না হলে নুন দেওয়া হয় না আর উনুন থেকে নামানো হয় না । সূর্য উঠলে পর নুন দিয়ে নেড়ে নামানো হয় । এতে ওই "বাসী হয়ে যাওয়ার" সংকট থেকে মুক্ত হন ওনারা !
শাস্ত্র বলছে , অধিকন্তু ন দোষা: .... ফলে সময়ের মধ্যে এই সাধারণ ক্রিয়া সম্পন্ন করে সময়ের পরে আপনি আবার মনমতোন উপাচারে অধিক পূজা করতেই পারেন ।
তবে কয়েকটি জিনিস তিথির ভিতরে করতেই হবে ! যেমন সপ্তমী তিথির ভিতরে নবপত্রিকা প্রবেশ , প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান পূজা করতেই হবে । খুব অসুবিধে হলে পরে ধীরে সুস্থে প্রতিমাস্থ দেবতার পূজা করা যেতে পারে কিন্তু পত্রী প্রবেশ বা প্রাণ প্রতিষ্ঠা কোনমতেই সপ্তমীর বাইরে করা যাবে না । তিথি পেরিয়ে গেলে অষ্টমীতে ওই কাজ সম্ভব নয় । করলে দেবীর আগমন আটকে যাবে! অর্থাৎ পুজো গোড়াতেই গলদ হয়ে গেলো !
অষ্টমীর তিথি যতই অল্প থাক ,তার মধ্যেই আপনাকে পুরোটা শেষ করতেই হবে কারণ অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট সন্ধি পূজার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে !
তবে সন্ধি পূজা নিয়ে কোনো কালেই কোনও অসুবিধে হয় না কারণ এই পূজার সময় নির্দিষ্ট । কোনও হেরফের হয় না । তবে সন্ধি পূজার মূল পূজাটি ওই ৪৮ মিনিটের মধ্যে শেষ করতেই হবে । স্তব স্তোত্র পাঠ ইচ্ছা অনুসারে পরে চলতে পারে । চেষ্টা করবেন যখন অষ্টমীর পূজা চলছে তখনই যাতে জোগাড়েরা সন্ধির আয়োজন চালাতে থাকে , নয়তো পরে সময় পাবেন না ! অষ্টমীর অঞ্জলী সংক্ষেপে এবং একত্রে দেওয়ানোর চেষ্টা করবেন সবাইকে বুঝিয়ে । দশটা ব্যাচ করতে গেলে মায়ের পূজা আর হবে না , শুধু অঞ্জলিটাই হবে !
সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো স্বতন্ত্র ব্রাহ্মণ এই অঞ্জলী দেওয়ার কাজটি চালিয়ে যেতে পারেন । তাতে পুরোহিতের এবং পূজার আরাম হয় । সর্বক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে দেবীর প্রীতিবিধানই উদ্দেশ্য ! তার পূজা সংক্ষেপ হতে পারে কিন্তু যাতে কোনরকম ত্রুটি না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখা কর্তব্য !
হোমের পূর্নাহুতি এবং দক্ষিনান্ত নবমী তিথির মধ্যে অবশ্য কর্তব্য । কারণ নবমীতে পূজা শেষ হচ্ছে । দশমী পূজার দিন নয় , ওটি বিদায় জানানোর দিন মাত্র । আর দশমীর দর্পণ বিসর্জন ইত্যাদি অবশ্যই তিথির মধ্যেই করতে হবে । একাদশী পড়ে গেলে দেবীর গমন সম্ভব নয় ! ফলে আবার পূজার খুঁত রয়ে গেলো !
দুর্গা পূজা মহাযজ্ঞ স্বরূপ বলে সময়ের এত গুরুত্ব! তাই ক্রিয়া কান্ডে অভিজ্ঞ পুরোহিত ব্যতীত এই ধরনের জটিল ক্রিয়া করা দুষ্কর ।